কমন একটা অভিযোগ শুনছি ইদানিং। প্যানডেমিকে বাচ্চা কাচ্চা বাসায় থেকে নাকি মা বাবাকে খুব বিরক্ত করছে। অনেক মা বাবাই প্রচন্ড হতাশ সন্তানকে ম্যানেজ করতে যেয়ে। ডিপ্রেশনেও চলে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
আমার অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করি। আমার সন্তান টিনেজ । বুঝতেই পারছেন মুড অন অফ তার চলেই। সে হচ্ছে ক্রিকেট ফুটবল পাগলা ছেলে। আমরা মফস্বলে থাকি বলে স্টেডিয়ামে যেয়ে নিয়মিত খেলতো। বাসার সাথেও লাগোয়া বিশাল মাঠ আছে আমাদের। সেখানেও রোজ বিকেলে খেলতো প্যানডেমিকের আগে। তাছাড়া স্কুল বাসে স্কুলে যাতায়াত করতো বলে সেখানেও আসা যাওয়ার সময়ে প্রচুর আড্ডা হতো বন্ধুদের সাথে। তো হঠাৎ করে পৃথিবী অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে ছেলে আমার পাঁচ মাস গৃহবন্দি। প্রথম কিছুদিন ঠিকঠাক গেলেও মাস খানেক পর থেকেই সে শর্ট টেম্পার হতে শুরু করলো। মুখ ভার। মন খারাপ।
এদিকে আমার তখনো ডিউটি চলছিল নিয়মিত। হাসপাতাল, বাসা , বাচ্চা সব মেইনটেইন একাই করতে হচ্ছিল। সাথে করোনা আতঙ্ক তো ছিলই। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাচ্ছিল আমার জন্য।
তখন আমি ছেলের জন্য একটা লাইফ স্টাইল সাজালাম মনে মনে। তাকে কিভাবে ব্যস্ত রাখা যায় তা নিয়ে রীতিমতো হোম ওয়ার্ক করলাম। ছেলের সাথেও আলোচনা করলাম। সে কি চায় বুঝতে চেষ্টা করলাম। বুঝলাম ব্যস্ত রাখলেই তার এনার্জি বার্ন হবে। তাহলে একটানা বাসাতে থাকতে সে বিরক্ত হবে না। এই ছিল মোটো আমার। ঘরের কাজ মা ছেলে ভাগাভাগি করে নিলাম। রাতের ডিস ক্লিনিং ছেলে করবে। এর বাইরে অনলাইনে হুজুর আর গিটারের ভাইয়াও ঠিক করলাম। দুটো টিউশনিও ছেলেকে ঠিক করে দিলাম। গ্রেড থ্রি আর কেজির ছাত্র পড়াবে। কয়েকদিনের মধ্যেই ছেলে আমার আগের মতো হাসি খুশি হয়ে উঠলো। মনমরা ভাবটা চলে গেল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল এসব নিয়ে।
বেসিক্যালি আমি খুবই হাত পা ছাড়া রিলাক্স টাইপ মা। ফাঁকিবাজও বলতে পারেন। সন্তানকে কখনো ব্লেন্ড করে খিচুড়ি খাওয়াই নাই আমি। আসলে সুযোগই পাইনি। সন্তানের খিচুড়ি খাবার বয়সে আমাকে নিজের লেখাপড়া শেষ করাতেই বেশি এফোর্ড দিতে হয়েছিল।
তাই আমার খাবারই বাবুকে নরম করে খাওয়াতাম। ছেলের লেখাপড়ার ব্যাপারেও আমি উদাসীন ছিলাম। এর ফলে আমার ছেলে একা একাই নিজের লেখাপড়ার বিষয়ে দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে। যদিও এখন মাত্র এইটে পড়ছে তবুও ওর লেখাপড়া নিয়ে আমাকে কখনোই worried হতে হয়নি। সে এখনই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্রিকেট আর বিজনেস প্রতিষ্ঠানের খোঁজ খবর রাখে নিয়মিত। রিসার্চ, ক্রিকেট আর বিজনেস এই তিনটাতে তার প্রবল আগ্রহ। জীবনটা তার। ছোট থেকেই নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিখুক এটাই আমি চাই। মা বলেই আমার সিদ্ধান্ত তার জীবনে চাপিয়ে দিতে আগ্রহী না আমি। এইটা হতে হবে, ঐটা হতে হবে কখনোই বলি না। শুধু বলি—- বড় হয়ে যাই হও না কেন জীবনে আনন্দে থাক এটাই চাই আমি।
আমি সন্তান লালন পালনে বেসিক কিছু নিয়ম ফলো করেছি সে আমার পেটে থাকার সময় থেকেই। প্রথমটা হচ্ছে কমিউনিকেশন। বয়সের সাথে সাথে ধরন বদলে গেছে তবে কখনোই আমাদের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হতে দেইনি। আমার ছেলের বন্ধুরাও জানে আন্টিই হচ্ছে আহ্ নাফের বেষ্ট ফ্রেন্ড। মায়ের সাথে সব শেয়ার না করলে তার রাতে ঘুমই নাকি আসে না।
আসলে কি জানেন একটা ঘটনাতে আপনি খুশি হবেন না অখুশি তা পুরোটাই ডিপেন্ড করে আপনার মাইন্ড সেটের উপরে। যেমন ধরুন আপনি যদি সন্তানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে ইনজয় করতে শুরু করেন দেখবেন তখন প্রেসার লাগবে না প্যারেন্টিং কে।
তবে প্যারেন্টিং একটা চর্চার বিষয়ও বটে। সন্তান জন্ম দিলেই শুধু তা হয়ে যায় না।
আমাদের দেশে সন্তানকে কয়জন মা বাবাই ইনডিভিজুয়াল আইডেন্টিটি ভাবে বলুন ? অধিকাংশ এখনো ভাবে সন্তান আবার কি বোঝে ? ওর মতামত আবার কি জিনিস ? সন্তানকে প্রাইভেসিই বা কজনে দেয় ?
সন্তানকে যদি আপনি বোঝাতে সমর্থ হন সে সংসারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। হোক ছোট তারও দায়িত্ব আছে সংসারে। তাহলেও অনেক বিষয় সহজ হয়ে যায়। অনেক মা বাবাই সন্তানের সাথে অনেককিছু লুকোচুরি করেন। এটাও ভুল। শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং সন্তান লালন পালনে এটা খুবই কার্যকরী পলিসি। আপনি যত শেয়ারিং হবেন দেখবেন সন্তান ততো কেয়ার করবে আপনার। আমি আমার অফিসের কথা, এমনকি স্যালারি, সেভিংস সংক্রান্ত বিষয়ও ওর বয়সের সাথে যায় এমন শব্দে আলোচনা করে এসেছি সেই পিচ্চিবেলা থেকেই। এতে অনেক উপকার হয় দেখেছি। সন্তান বুঝে নেয় সকাল বেলাটা পরিবারের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সবাইকে কাজে, স্কুলে যেতে হয়। সুতরাং খাওয়া, রেডি হওয়া নিয়ে উল্টাপাল্টা করা যাবে না। এটা একটা উদাহরণ মাত্র।
কোভিড ১৯ এর কাছে একটা কারনে আজীবন আমি কৃতজ্ঞ থাকব। আমার ছেলেটা কে এত লম্বা সময় ধরে চোখের সামনে দেখতে পারছি। এটা আমার মতো কর্মজীবী মায়ের কাছে রীতিমতো ব্লেসিংস। আমার আম্মুকে গতকাল বলছিলাম আম্মু আমার আহু কত বড় হয়ে গেল। আর মাত্র চার বছর। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে এরপর ওর ভার্সিটি জীবন শুরু হবে। হয়তো দেশেই থাকবে না। আমার খালি কান্না আসে এসব ভাবলে। আহু ঘুমিয়ে গেলে ওর মুখটা শুধু দেখি। কত তাড়াতাড়ি সময় চলে গেল। তিন বছরের যে ছোট্ট বাবুটার হাত ধরে আমার কঠিনতম জীবনটা শুরু হয়েছিল সব অন্ধকারকে পেছনে ঝেড়ে ফেলে সেই বাবুটাই আজ তেরো চৌদ্দ বছরের কিশোর। টেরই পেলাম না দিন গুলো কিভাবে চলে গেল। দশটা বছর !!!! এই ছেলেকে সাথে নিয়ে অফিসও করেছি আমি কতগুলো বছর ! এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ছাড়া করি নাই ওকে। বিনিময়ে এখন দেখি ছেলে আমার স্পর্শেই বুঝে ফেলে মায়ের পালস। একদম সহজ না একা একজন মানব শিশুকে একা হাতে আনন্দ সহকারে ভালোবেসে নিজের জীবনের সবটুকু উজার করে দিয়ে একটু একটু করে বড় করে তোলা। আলহামদুলিল্লাহ অনেকট পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। বেঁচে থাকলে বাকীটাও পারব ইনশাআল্লাহ।
মা বাবা হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা না বলুন ? পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর সত্য হচ্ছে এই সম্পর্কটা।
পৃথিবীর প্রত্যেকটা সন্তান যেমন ইউনিক ঠিক তেমনি প্রত্যেকটা প্যারেন্টসও কিন্তু ইউনিক। তাই চলুন শুধু কর্তব্য করতে না বরং আনন্দ নিয়ে উপভোগ করি প্যারেন্টিংটা। ওরা তো নিজেদের ইচ্ছেয় পৃথিবী নামক এই unpredictable গ্রহতে আসেনি। আমরাই এনেছি ওদেরকে। তাই ওদেরকে সুন্দর, সুস্হ, নিরাপদ, আনন্দময় একটা জীবন দেবার দায়ভার আমাদের ই , অন্ততঃ যতদিন ওরা বড় না হচ্ছে এবং আমাদের কাছে থাকছে।