Ameena Chowdhury | Inspiration

অনুপ্রেরণা

– কেউ আপনার সাথে অন্যায় করছে? নিছক হিংসার বশে ছোট একটা কাজে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করছে? আপনার ছোট্ট সাফল্যেও খুঁত ধরার চেষ্টা করছে? তারা হয়তোবা আপনার থেকে অনেক বেশি সফল। তারপরও আপনার ক্ষুদ্র প্ৰাপ্তিতেও তাদের সমস্যা। আপনি হয়তো তাদের সাথে কিছুই করেননি। তাদেরকে নিয়ে আপনার আসলে কোনো মাথা ব্যথাই নেই। আপনি আছেন আপনার মতো। তারপরও জোরপূর্বক আপনার জীবনে এসে আপনাকে প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে? আর আপনি ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছেননা যে আপনার কী করা উচিত?

কথাগুলো বলে আমি একটু বিরতি নিলাম। সেই কয়েক মুহূর্তের বিরতিতে আমি আমার সামনে সারি সারি চেয়ারে বসে থাকা সবার মুখের ভাব বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম। ছোট্ট এই হলঘরে ঠাসাঠাসি করে বসে আছে জনা পঞ্চাশ মহিলা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই আছে। ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার পরের কথাগুলো শোনার অপেক্ষায়। তারা যেন কেউ জানেনা যে তাদের কী করা উচিত। আমার সব বলে দিতে হবে। সেই অনুযায়ী তারা কাজ করবে। আমি একটু গলা খাকারি দিয়ে আবার শুরু করলাম,

– বলেন, আপনার কী করা উচিত? আপনি তাদের সাথে ঝগড়া করবেন? রাগ করবেন? তাদের কথা শুনিয়ে বুঝিয়ে দেবেন যে তারা ঠিক করছেনা? নাকি আপনি মন খারাপ করবেন, কান্নাকাটি করবেন, কষ্ট পাবেন, তাদের কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিবেন? ছোট্ট যেই কাজে তারা বাধার সৃষ্টি করছে তা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন? ছোট্ট একটু সাফল্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন?

এই বলে আমি আবারো ছোট্ট বিরতি নিলাম। সবার দিকে তাকিয়ে আছি। সবার মনের ভাব বুঝার চেষ্টা করছি। সবাই আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, উত্তরের অপেক্ষায়। আমি আবারো শুরু করলাম,

– নাহ, আপনি এসব কিছুই করবেন না। আপনি কাউকে কিছু বলবেনও না আর নিজেকে গুটিয়েও নিবেন না। আপনি নিজের কাজে মনোনিবেশ করবেন। মন প্রাণ দিয়ে আপনি নিজেকে তৈরী করে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাবেন যে আপনার সেই অবস্থানই তাদের অন্যায়ের জবাবের জন্য যথেষ্ট। বিশ্বাস করেন, এর চেয়ে ভালো জবাব আর কিছু হতে পারেনা। আর সেই অবস্থানে যাবার জন্য কী প্রয়োজন জানেন?

হল ভর্তি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। সবাই কি ভাবছে যে আমি এখন সবার হাতে আলাদিনের চেরাগ তুলে দিবো? আমি একটু যেন নার্ভাস ফিল করছি। এতগুলো মানুষ আশা নিয়ে আমার কথা শুনতে এসেছে। আমি তাদের হতাশ করতে চাইনা। কিন্তু আমার কথা তো আমাকে বলতেই হবে। আমি একটু দম নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম,

– এর জন্য প্রয়োজন সময় এবং শ্রম। এর কোনো বিকল্প নেই। সময় নিয়ে পরিশ্রম করে আপনাকে সেই অবস্থানে পৌঁছাতে হবে। এমন এক অবস্থান যেখানে পৌঁছলে আপনাকে কথা শুনানোর কারো সাহস হবেনা। আর কেউ কথা শুনালেও আপনার কিছু আসবে যাবে না।

আমি একটু থেমে আবারো শুরু করলাম,

– আপনি পারবেন। এর জন্য আপনাকে অসাধারণ কিছু হতে হবেনা। অনেক মেধাবী, জ্ঞানী, গুণী বা অর্থশালী কিছুই হওয়া লাগবেনা। অনেকের সাহায্য, সহযোগিতা বা অনুপ্রেরণাও লাগবেনা। আপনাকে সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছাতে হবেনা। আপনি আপনার ক্ষমতা অনুসারে আপনার শ্রম দিয়ে কষ্ট করে যা অর্জন করবেন তার ভিত এত মজবুত হবে যে, কারো ক্ষমতা নেই সেই ভিতে ফাঁটল ধরানোর। সেই অর্জন শুধু মজবুতই হবেনা, দেখবেন আর মধ্যে থাকবে মানসিক প্রশান্তি।

এই কথা বলে আমি একটু থামতেই পুরো হলঘর প্রবল করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো।

স্পিচ শেষে আমি হলের শেষ প্রান্তে এক কাপ চা হাতে নিয়ে বসে আছি। এখন হালকা গান বাজনা চলছে। ফর্মাল কোনো অনুষ্ঠান না, এই সমিতির মহিলারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে গান, কবিতা আবৃত্তি এসব করছে। অনেকেরই আবার সেই গান কবিতায় মন নেই। নিজেদের মতো করে আড্ডা মারছে। অনেকে আবার আমার সাথে গল্প জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার গল্প, অনুপ্রেরণার সব গল্প। আজ আমার গল্পে কোনো মন নেই। শরীরটা কেন জানি খুব একটা ভালো লাগছেনা।

আমি চায়ের কাপটা রেখে উঠে পড়লাম। বাড়ি ফেরা দরকার। নাহ, আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। প্রায়ই বুকে এক ধরনের চাপ ব্যথা অনুভব করছি। একটু ভালোমতো ডাক্তার দেখানোর দরকার। এই স্পিচ দেওয়া থেকে কয়েকদিনের জন্য একটু ব্রেক নিয়ে নিবো নাকি? কিন্তু আমি বিরতি নিলে যে কত মেয়েদের অনুপ্রেরণায় ঘাটতি পড়বে।

আমি বাংলাদেশের একজন নামকরা মোটিভেশনাল স্পিকার। কিছুদিন আগ পর্যন্তও নামি দামি পরিবারের অর্থশালী মহিলারা গাদাখানিক টাকা দিয়ে টিকেট কেটে আমার কথা শুনতো। আমি কথা বলে শুধু মহিলাদের জীবনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিই না, সাথে অনেক অনেক টাকা কামিয়েছিও। এই কিছুদিন হলো আমি কাজ থেকে অবসর নিয়েছি। আমার বয়স ষাট বছর। সেভাবে দেখতে গেলে আর্লি রিটায়ারমেন্টই বলা যায়। অনেক তো হলো কথা বলা, অনেক তো হলো টাকা কামানো। ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা আরাম করে কাটিয়ে দিবো আর মাঝে সাঝে খেটে খাওয়া দুঃখী দুস্থ মেয়েদের কাছে গিয়ে অনুপ্রেরণার কথা বলবো। আজকের এই সমিতির স্পিচটা সেই ধরণের মহিলাদের জন্যই। তবে দেখলাম এই কথা বলাটা এক ধরণের নেশার মতো। আর যেহেতু আমি আর টাকার বিনিময়ে কাজটা করিনা, এর প্রাপ্তিটা আরো বিশাল মনে হচ্ছে। এই মেয়েগুলোর সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারিনা। আমার অবসর জীবন তাই আজ আমার কর্ম জীবনের থেকেও ব্যস্ত কাটছে।

ভাবতেই অবাক লাগে যে আমি পেশা হিসেবে এই কাজটাকে বেছে নিয়েছিলাম। যেই কাজে “কথা” বলে জীবন পার করে দিতে হবে। অথচ এই আমিই একসময় দুটো লাইন কথা বলে উঠতে পারতাম না। আমার ছোটবেলায় ভয়াবহ স্ট্যামারিংয়ের সমস্যা ছিল। স্কুলে সবাই আমাকে তোতলা বলে খেপাতো। কথা বলার ভয়ে আমি কুঁকড়ে থাকতাম। যতই আমার কথা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো, ততই ভয়ে আমার তোতলামি আরো বেড়ে যেত। মনে মনে আমি দোয়া করতাম, আমি যেন জনমানব শূন্য কোথাও গিয়ে বাকি জীবন কাটাতে পারি। আমার যেন আর কারো সাথে কোনোদিন কথা বলার প্রয়োজন না হয়।

আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমি অংকে কিছুটা ভালো ছিলাম। অন্য কোনো বিষয়ে খুব ভালো না করলেও পরীক্ষায় প্রায়ই অংকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেতাম। অংক ক্লাসে অংকের মধ্যে ডুবে গিয়ে কিছুক্ষনের জন্য তোতলামির যন্ত্রনা ভুলে যেতাম। আমার অংকের ম্যাডামও আমাকে ভীষণ আদর করতো। আর তার ক্লাসে যেন আমি একটু স্বস্তি বোধ করতাম। সেই স্বস্তি বোধ করার কারণেই মনেহয় ম্যাডাম কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা কম তোতলাতাম। কিন্তু এই যে আমি অংকে একটু বেশি নাম্বার পেতাম, সেটা আমাদের ক্লাসে যেই মেয়েটা সবসময় ফার্স্ট হতো তার সহ্য হতোনা। অংক ক্লাসে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নানান মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে আমাকে ঘাবড়ে দেবার চেষ্টা করতো সে। মেয়েটি খুব ভালো করেই জানতো যে আমি ঘাবড়ে গেলে আরো তোতলানো শুরু করি, তখন নার্ভাস হয়ে অংকও পর্যন্ত ভুল করে ফেলি।

আমার খুবই অবাক লাগতো। সে তো ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। আমি একটু অংকে তার থেকে ভালো নাম্বার পেলেই কী আর না পেলেই কী। সে সব বিষয়ে এত ভালো যে সে ফার্স্ট হবেই হবে। জীবনে আমি এই একটা জিনিস একটু ভালো করে করতে পারি। তাতে কেন তার এত সমস্যা? আমিতো সবার কাছে সব ব্যাপারে হাসির পাত্র, এই সামান্য অংক করার মধ্যে দিয়ে যদি ক্ষনিকের স্বস্তি মিলে তাহলে কারো কেন সমস্যা হবে?

কিন্তু আমাদের সেই ফার্স্ট গার্ল সব বিষয়ে হাইয়েস্ট নাম্বার পেয়ে অভ্যস্ত। তাই আমার অংকে বেশি নাম্বার পাওয়া তার জন্য অপমানজনক ব্যাপার। সে উঠতে বসতে আমার পিছনে লাগা শুরু করে দিলো। সে আমার বন্ধু বন্ধু ভাব করে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যখন তখন যার তার সামনে এমন সব প্রশ্ন করে বসতো যে উত্তর দিতে গিয়ে আমি তোতলাতে তোতলাতে অস্থির হয়ে যেতাম। কখনো ক্লাসে কিছু জানতে চাওয়ার ছলে, বন্ধুদের আড্ডায় গল্পের ছলে, খেলার সময় খেলার ছলে সে আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলতো। আর আমি কথা বলতে গিয়ে সবার হাসির পাত্রে পরিণত হতে লাগলাম। আর সেই হাসিতে সবার আগে যোগ দিতো সেই মেয়েটি। প্রথম প্রথম এই অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য আমি নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু তাও সে আমার পিছু ছাড়তোনা। আমার মাঝে মাঝে মনে হত যদি এমন কোনো জাদুকরী ঔষধ থাকতো যেটা খেয়ে নিলে আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম।

ব্যাপারটা সেসময় আমার জীবনে অভিশাপের মতো মনে হলেও তা আসলে ছিল একধরণের আশীর্বাদস্বরূপ। ভীত, কুন্ঠিত, অপমানিত, লজ্জিত আমি তিল পরিমান লুকানোর জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তোতলাতে তোতলাতে সবার সামনে কথা বলা শুরু করলাম, নিজেকে জানার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম যে নার্ভাস হলে আমি বেশি তোতলাতে থাকি। নিজে নিজে চেষ্টা করে বুঝার চেষ্টা করলাম যে ভয়ের মুহূর্তগুলো কিভাবে নিজেকে ঠান্ডা রাখা যায়, কিভাবে ভয়কে জয় করা যায়। বুঝতে চাইলাম যে কোন কোন শব্দ বলতে আমার সবচেয়ে কষ্ট হয়। একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই শব্দগুলো বলে বলে চর্চা করতাম। মনে শক্তি সঞ্চয় করে আমার অংক ম্যাডামের কাছে সাহায্য চাইলাম। তিনি আমাকে আরেকজন শিক্ষকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি আমাকে এব্যাপারে সাহায্য করেছেন। সেই শিক্ষক আমাকে কিছু গল্প প্রতিনিয়িত জোরে জোরে রিডিং পড়ার অভ্যাস করতে বলেছিলেন। সাথে আমাকে কিছু টিপস শিখিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন ধীরে ধীরে কথা বলা, যেই শব্দগুলো বলতে সবচেয়ে কষ্ট হয় সেই শব্দের বিকল্প কিছু শব্দ ব্যবহার করা আর মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। তিনি আমাকে এও বলেছিলেন যে ব্রেনকে এখন থেকে ভালোমতো ট্রেইন করলে, বয়সের সাথে সাথে নাকি আমার মতো ভয়াবহ তোতলানোও জয় করা যায়।

আমি মন প্রাণ দিয়ে দিনের পর দিন আমার ব্রেইনকে ট্রেইন করার চেষ্টা করেছিলাম। শুধু তাইনা, যদিও অংক ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ভালো করার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই ছিলোনা, শুধু জেদের বশে আমি রাত দিন পড়াশুনা করা শুরু করে দিয়েছিলাম। একদিনের ব্যাপার না, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, ধীরে ধীরে আমি ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে নিজেকে অগ্রসর করেছিলাম। চার বছর পর এসএসসির সময় আমি স্কুলের সুপার ষ্টার বনে গিয়েছিলাম। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল আমি, সব বিষয়ে পারদর্শী আর সাথে কী সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারি। আর আমি যখন সুপার ষ্টার বনে গেলাম, তখন আমার সেই আগের ফার্স্ট গার্ল যে তখন সেকেন্ড গার্ল, তাকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও হেয় করার চেষ্টা করিনি। নাহ, তাকে আমি ভালোবাসতে পারিনি কিন্তু চেষ্টা করেছি আমার কোনো কার্যকলাপে সে যাতে কষ্ট না পায়। কেননা আমি জানি আমি নিজেকে এমন অবস্থানে নিয়ে গিয়েছি যে আমার প্রতি তার ব্যবহারের জবাব তাকে আমি আমার কাজের মধ্যে দিয়ে দিয়েছি। আর সেটা তার জন্য যে কতখানি পীড়াদায়ক ছিল তা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি।

তবে ভয়াবহ তোতলা থেকে মোটিভেশনাল স্পিকার হয়ে আমি পৃথিবী জয় করে ফেলিনি। নাহ, আমার জীবন শুধুমাত্র অনুপ্রেরণা আর সাফল্যে ভরে উঠেনি। আমার জীবন ছোটোখাটো ব্যর্থতা আর অপূর্ণতায় পরিপূর্ণ, যেমনটা সবার জীবন হয়। এক জীবনে কি আর সব পাওয়া সম্ভব? আমার সংসার জীবন খুব একটা সুখের ছিলোনা। দীর্ঘ পনেরো বছর সংসার করার পর আমার স্বামীর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে জীবন যে খুব একটা খারাপ কেটেছে তা বলবোনা। তবে খুব যে আনন্দে কেটেছে তাও না। আমার ছেলেটা তো এক পর্যায়ে একেবারে বখে গিয়েছিলো। অনেক সাধ্য সাধনা করে তাকে সুস্থ জীবনে ফেরানো হয়েছে। ছেলে মেয়ে দুইজনই এখন বড় হয়ে গিয়েছে, যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। বাহিরে থেকে দেখতে গেলে অনেকের হয়তোবা আমার জীবনকে নিঃসঙ্গ এবং দুঃখী মনে হয়। অন্তত নিন্দুকের তো তাই মনে হয়। অবশ্য নিন্দুকের কথায় বা কাজে আমার কিছুই আসে যায়না। সেই ক্লাস সিক্সে পড়া অবস্থায় ক্লাসের ফার্স্ট গার্লেই শেষ হয়ে যায়নি, এর পর আরো কত মানুষ জীবনের পদে পদে বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমার ব্যর্থতা বা অপূর্ণতা আমাকে মনে করিয়ে আমার সফলতাকে হেয় করার চেষ্টা করেছে। সবকিছু অগ্রাহ্য করে আমি সবসময় আমার কাজে মন দেবার চেষ্টা করেছি।

আমার সবসময় মনে হয়েছে যে আমার অপূর্ণতা হলো অপূর্ণতার জায়গায় আর আমার সফলতা হলো সফলতার জায়গায়। যেই মেয়েটার কাছে একসময় সাধারণ কিছু কথা বলে উঠতে পারাও ছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার, সেই মেয়েটির কাছে আজ কথা বলতে পারাটাই জীবনের সবচেয়ে বিশাল আর সবচেয়ে আপন অংশ। এখনো মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে, অশান্তিতে থাকলে আমার সেই ছোটবেলার তোতলামিটা একটু হলেও ফিরে আসে। কিন্তু আমি এখন রপ্ত করে নিয়েছি সেটাকে কেমন করে আড়াল করে রেখে কথা চালিয়ে যেতে হয়। সেই কথার মধ্যে দিয়ে কত মেয়েদের আমি অনুপ্রেরণা যোগাই, কত নারী যারা অপরের কথায় পিছিয়ে গিয়ে আবার আমার কথায় সামনে এগিয়ে যায়। কথা বলেই আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করেছি, অচেনা অজানা মানুষের কাছ থেকে অফুরান ভালোবাসা পেয়েছি, কত মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছে, আমার জীবনের সব অপূর্ণতা ছাপিয়ে আমার জীবনটাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছে। আর সামান্য দুয়েকজন নিন্দুকের কথায়, জীবনের অন্যান্য অপূর্ণতার কারণে আমার এই সাফল্যকে যদি ছোট করে দেখি, তাহলে আমার সারাজীবনের অর্জনই তো বৃথা। এত কষ্টের অর্জন তো আমি বৃথা যেতে দিতে পারিনা। আমার এই অর্জন যে আমার নিজের কাছেই ভীষণ অনুপ্রেরণার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

About Author

Donation

Support Our Cause

HerWILL is a nonprofit organization. Your support enables us to accomplish our ambitious goals.

Related Posts

Recent Posts