Finding own Identity

রাত প্রায় বারোটা বাজে। এহসান তখনও বাড়ি ফেরেনি। মিলি ওর দুই বাচ্চাকে ডিনার করিয়ে নিজেও খেয়ে নিয়েছে আধ ঘণ্টা আগে। আর কত অপেক্ষা করবে ?

রাত দশটা থেকে এ পর্যন্ত সাত বার কল দিয়েছে ও এহসান এর ফোনে। প্রতিবার রিং হয়ে কেটে গেছে। আল্লাহ জানে কি এমন ব্যস্ততা। এত রাতে তো আর অফিসিয়াল মিটিং হবার কথা না। কোন বিপদ হল না তো – ভেবে একটু টেনশন হয় মিলির।

এহসানকে না পেয়ে মিলি এহসানের বেস্ট ফ্রেন্ড মামুনের ফোনেও ট্রাই করেছে বেশ কয়েবার। সেও রিসিভ করেনি।

মিলির ভীষণ ক্লান্ত লাগে। সারাদিন এত দৌড়ঝাঁপ, বাচ্চাদের স্কুল,খাওয়ানো,পড়ানো,রান্না,ঘর পরিস্কার করা। রাত নটা দশটা বাজলে আর শরীর চলে না।বিছানায় পিঠটা লাগাতে পারলে তবে শান্তি।

বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে ড্রইংরুমে বসে ঢুলু ঢুলু চোখে কিছুক্ষন টিভি দেখার চেষ্টা করে মিলি।চেষ্টাই ওটা কারন সময়ের অভাবে টিভি দেখার অভ্যাসটাও নষ্ট হয়ে গেছে। তবে চেষ্টাটা বেশীক্ষন চালাতে হল না।

কিছুক্ষনের মধ্যেই কলিং বেল বাজলো।মিলি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল তারপর আবার সোফায় গিয়ে বসলো।

স্বামী ঘরে ঢোকার সাথে সাথে কোন ইস্যু নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া মিলির সভাব নয়।তাই এহসানকে এটাও জিজ্ঞেস করেনি, কেন দেরী হল এই বিষয়ে।নিজে থেকেই হয়ত বলবে অথবা আস্তে ধীরে জিজ্ঞেস করবে মিলিই একটু পরে।

কিন্তু সকলের স্বভাব তো আর এক নয়।এহসান জুতা খুলে ঘরে ঢুকেই মিলির কাছে এসে উত্তেজিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো

– মামুনকে ফোন দিয়েছিলে কেন?

– তোমাকে এতবার ফোন দিলাম তুমি রিসিভ করলে না তাই মামুন ভাইকে দিলাম। ভাবলাম উনি যদি তোমার সাথে থেকে থাকেন। আর না থাকলেও হয়ত জানবেন তুমি কই ।কিন্তু উনি রিসিভ করলেন না অথচ তোমাকে ঠিকই জানিয়েছে। আশ্চর্য তো!

এহসান নিজেও জানে যে মিলি মামুনকে ফোন দিয়েছে কেন।তবুও এক অজানা কারনে আবার কুতসিত ভাবে জিজ্ঞেস করে

– আমি ফোন না ধরলেই আরেকজনকে ফোন দিতে হবে? আমি কি ফিরতাম না কোনদিন বাসায় ?স্পাইং করার জন্য দিয়েছ নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যে ? ঠিক করে বল ফোন কেন দিয়েছ?

এহসান অকারনে মিলিকে হেনস্থা করতে শুরু করে যেরম প্রায়ই সে করে,সম্পূর্ণ অকারনে।

হয়ত স্ত্রীকে হেনস্থা করাকেও এক ধরনের পুরুষত্ব বলে ভাবে সে। অথবা এটা কোন ডিফেন্স মেকানিজম। জবাবদিহিতা এড়ানোর টেকনিক। বউ কোন প্রশ্ন করার আগে উল্টা তাকেই জর্জরিত করে রাখা।

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মিলির অদ্ভুত লাগে।এহসানকে নয় তার নিজেকেই। প্রেম করে বিয়ে করেছিল ওরা। দুই বছর কাছ থেকে দেখেছে এহসানকে। ও ভীষণ পুরুষবাদী এটাও বুঝেছে কিন্তু এতোটা এবিউসিভ হবে এই ধারনা কখনও ছিল না।

মিলির হঠাত প্রচণ্ড রাগ হয়। ও উত্তর দেয়

– তোমার কি ধারণা আমি তোমার বন্ধুর সাথে প্রেম করার জন্য কল দিয়েছিলাম? আশ্চর্য।

তারপর সোফা থেকে উঠে যখনই ও বেডরুম এর দিকে যাবার চেষ্টা করে তখন হঠাত এহসান এসে ওর চুল ধরে টানতে শুরু করে আর জান্তব গলায় বলতে থাকে

– এত বড় সাহস। মুখে মুখে তর্ক করিস।প্রেম করবি আমার বন্ধুর সাথে? এত বড় সাহস তোর।যা কর প্রেম দেখি কেমন পারিস।

ঘটনার আকস্মিকতায় মিলি স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটা কথাও আসে না ওর মুখে।ধপ করে ও বসে পড়ে আবার সোফায়। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় ওর।

দুই চোখ দিয়ে ঠিক কেন পানি গড়িয়ে পড়ছে এটাও বুঝতে পারেনা।

চুলটা পোনিটেল করে বাঁধা ছিল তাই ব্যাথা লাগেনি অত।সামান্য কিছু চুল ছিঁড়েছে শুধু।

সম্ভবত চোখের পানির কিছু অংশে ছিল ভালবেসে ধোঁকা খাওয়ার অনুভুতি, কিছু অপমানের আর কিছু অনভ্যস্ততার। কারন এহসান এর আগে কেউ কোনদিন ওর গায়ে হাত তোলেনি।

এহসান এর আগেও দুই একবার চড় চাপড় দিয়েছে। সেগুলো হজম করে নিয়েছে মিলি উপায় নেই বলে।বাচ্চা দুটো ছোট, ও চাকরী বাকরী কিছু করেনা।

আর তার থেকেও বড় কথা এহসানকে তখন অব্দি ভালোবাসা বন্ধ করতে পারেনি ও। আশা করেছে এহসান বদলাবে কোনদিন।

কিন্তু আজ যেন ভীষণ বাড়াবাড়ি হয়ে গেল,যেন সব আশা মিথ্যে হয়ে গেল।

মিনিট দশেক পর সম্বিৎ ফিরে পায় মিলি। আস্তে আস্তে এগোয় বাথরুম এর দিকে। এহসান তখন নির্বিকার ভাবে কাপড় চেঞ্জ করছে,যেন কিছুই হয়নি। এভ্রি থিং ইজ ইন পারফেক্ট অর্ডার।

মিলি বাথরুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে প্রথমে মুখে হাত চেপে হাওমাও করে কাঁদে কিছুক্ষন।সেটাও দুঃখের কান্না না ।নিজের উপর জেদ হয় ওর খুব। মরে যেতে ইচ্ছে করে।

কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো এই ঘটনা। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা করতে হবে ধ্বংসাতক নইলে শান্তি লাগে না।

তারপর আস্তে আস্তে উঠে বেসিন এর কেবিনেট থেকে কেচি বের করে পোনিটেল এর গোঁড়ায় ধরে নিজের চুলগুলো কচ কচ করে কেটে ফেলে ও।

হ্যা, ওর মেঘকালো,ঘন,কোমর ছাপানো চুল গুলো ও কেটে ফেলে এক নিমেষে। ওর চুলগুলোর প্রশংসা করত সবাই। এমনকি এহসানও করত খুব বিয়ের আগে।

বিয়ের পরে আর করেনা। সম্ভবত বউ এর প্রশংসা করতে পুরুষদের ইগোতে লাগে।হয়ত ভাবে বেশী প্রশংসা করলে বউ মাথায় উঠবে।

এমনিতে মিলি খুব বেশী সৌন্দর্য সচেতন নয় কখনোই।খুব একটা পারলার টারলারেও যায়না।তবে বেশ কিছুদিন ধরে ওর ভীষণ ইচ্ছে করছিল চুল গুলো রঙ করাবে,হাইলাইট যাকে বলে। কিন্তু এহসানকে এই কথা বলতেই উত্তর দিয়েছিলো

– চুল রঙ করলে বাসা থেকে বের করে দেব।আমার বাসায় থেকে এইসব বাজারী মেয়ে ছেলেদের মত কাজ করা চলবে না।

পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে মিলি চুল এর কাটা অংশ গুলো তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। তারপর কল খুলে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। আয়নায় নিজের উদ্ভট চেহারা দেখেও ওর কোন অনুভুতি হয়না আর।

ও যখন বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে তখন এহসান ডিনার শেষ করে সিগারেট ধরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হঠা মিলির দিকে চোখ পড়তেই ভুত দেখার মত চমকে উঠে,চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে

– এটা কি করেছ তুমি ? এই মেয়ে তুমি কি পাগল হয়ে গেছ ?

মিলি কথা উত্তর না দিয়ে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ে। ওর এত ক্লান্ত লাগে যে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়েও পড়ে।

পরদিন ছিল ছুটির দিন।

এহসান ঘুম থেকে উঠবার আগেই মিলি বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে যায়।বেরোবার সময় মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টানে বাধ্য হয়ে কারন ওকে দেখে মনে হচ্ছে কোথাও চুরি করতে গিয়ে ধরা পরার পর জনগন ওর চুল কেটে দিয়েছে ।ইনফ্যাক্ট সকাল ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই ঘোমটা দিয়ে আছে।

বাচ্চাদেরও দেখাতে চায়নি নিজের এই চেহারা।

মায়ের বাসার নিচ পরযন্ত বাচ্চাদের পৌঁছে দিয়ে ও চলে যায় পার্লারে। এই চুল এর একটা ব্যবস্থা না করে জনসমক্ষে যাবার উপায় তো নাই।বাকী সব চিন্তা এর পরে।

যে মেয়েটা ওর চুল কাটবে সে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে

– এমন কিভাবে হল আপু?

মিলি হেসে বলে

– আমি কেটে ফেলেছি ঝুটি ধরে ।

– কেন ?

মিলি হা হা করে হাসে, বলে

– মনে অনেক আনন্দ হয়েছিলো তো,তাই ।

পার্লারের মেয়েটা আর কথা না বাড়িয়ে চুল কাটতে শুরু করে। ভীষণ কষ্টে সে যখন চুলে একটা শেইপ দিতে পেরেছে তখন মিলির চুল কান পর্যন্ত উঠে এসেছে। কিন্তু তবুও চুল কাটা শেষ হবার পর ভীষণ সুন্দর দেখায় ওকে ।

মিলি মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে

– কালার সেকশন থেকে কাউকে আসতে বলেন প্লিজ।আমি চুলে কালার করব।

সব শেষ হবার পরে আয়নার দিকে তাকিয়ে মিলি মুগ্ধ হয়ে যায়।নতুন হেয়ারকাট, গোল্ডেন ব্লন্ড চুলে মিলির নিজেকে সম্রাজ্ঞীর মত লাগে। ওর ভেতর অদ্ভুত এক কনফিডেন্স তৈরি হয়।অবাক হয়ে খেয়াল করে লম্বা চুলের চেয়েও এই হেয়ারকাট ওকে মানিয়েছে বেশী।

পার্লার থেকে বের হবার আগে মিলি দেখে ওর সাইলেন্ট করা ফোনে সাতাশটা মিসড কল এহসান এর।এটাও স্বাভাবিক মিলির কাছে। মিলি কোথাও গেলে এহসান এভাবেই ফোন করে।ননস্টপ কল দিতেই থাকে। যত সমস্যাই থাকুক মিলিকে ফোন ধরতেই হয় এবং অবশ্যই দেরী করে ফোন ধরার অপরাধে গালিগালাজ শুনতে হয়।

আজ প্রথমবার মিলি এক বিন্দুও ভয় পেলো না মিসড কল দেখে।ও পার্লার থেকে বেরিয়ে বাবার বাড়ি না গিয়ে সরাসরি এহসান এর বাসায় এলো। হ্যা এহসানের বাসাই কারন এই বাসাটাকে কাল রাতের পর থেকে আর নিজের বাসায় ভাবতে পারছে না ও।

ঘরে ঢুকবার সাথে সাথে এহসান এমন ভাবে তাকালো যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে ওকে।

মিলি বুঝতে পারলো এটা ভয় দেখানোর অভিনয়। এহসান আসলে ওর নতুন রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে, কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকাও খেয়েছে।

তার সাদাসিধা গ্ল্যামারলেস বউকে এরকম বোম এর মত সুন্দরী লাগতে পারে এটা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। তবে সেকথা বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। আর গতকালের ঘটনার পরে তো আরও বলা যায় না।

মেয়ে মানুষ এর এত জেদ থাকবে কেন? স্বামী চুল ধরে টানলেই বাথরুমে ঢুকে চুল কেটে ফেলতে হবে ? আবার ওর অনুমতি ছাড়া চুলে রঙ করে এসেছে। এত বড় স্পর্ধা ?

আজকে বউকে বোঝাতে হবে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার পরিনতি কত কঠিন।চরম ভয় দেখাতে হবে যাতে জীবনে আর এত সাহস না দেখাতে পারে।

কিন্তু এহসান খেয়াল করে, ওর অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে মিলি কাপড় প্যাক করতে শুরু করেছে দুই বাচ্চার আর নিজের।

এহসান এবার কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে- কি হচ্ছে এসব ?

মিলি উত্তর না দিয়ে নিজের মত কাজ করতে থাকে। ওর চেহারায় এমন কিছু ছিল যে সেদিন প্রথমবারের মত এহসান দমে যায়। আর ঘাঁটানোর সাহস পায়না ওকে ।

কাপড় প্যাক করা শেষ হবার পরে মিলি দরজার দিকে এগোতে থাকে এহসান আসে ওর পিছু পিছু।

দরজার কাছে পৌঁছে মিলি এহসানের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে।

– আমি চলে যাচ্ছি এহসান।

– এহসান শুকনো কণ্ঠে বলে

– চলে যাচ্ছ মানে ? কই যাচ্ছ ? কেন যাচ্ছ ?

মিলি উত্তর দেয়

– যাচ্ছি কারন এই ঘরটাকে আর নিজের ঘর মনে হচ্ছে না তাই,এখনও আত্মসম্মানবোধ নামক একটা জিনিস আমার মধ্যে অবশিষ্ট আছে তাই।সবচেয়ে বড় কারন, আমি আর তোমাকে ভালবাসিনা তাই।

এহসান কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। হয়ত বুঝতে পেরেছে,এই সময় কিছু বলে লাভ নেই । দরজায় নির্বাক দাড়িয়ে ও মিলির চলে যাওয়া দেখে।

ঠিক লিফট এ উঠার আগ মুহূর্তে মিলি এহসান এর দিকে আরেকবার ঘুরে দাঁড়ায়।তারপর হাসি হাসি মুখে বলে,

– চুল ধরে টানার জন্য অনেক ধন্যবাদ এহসান।তুমি চুল ধরে টেনেছিলে বলেই বোধহয় ঘুমিয়ে থাকা আত্মসম্মানটা জেগে উঠেছিল ফাইনালি। আর আমার এত সুন্দর মেক ওভারের কৃতিত্বটাও তোমার।

শুধু একটাই আফসোস তুমি আরও আগেই চুল ধরে টানলে জীবনের দশটা বছর নষ্ট হত না।তবে অসুবিধা নেই,অবশিষ্ট আত্মসম্মান আর নিজের শিক্ষা টুকু দিয়ে নিশ্চয়ই কিছু একটা করে খেতেই পারব।তাই তোমার পুরুষত্বের প্রতি সত্যিই আমার কৃতজ্ঞতা রইলো।

তোমার ওই পুরুষত্বটুকুর কারনেই সামান্য দেরীতে হলেও,

“এহাসানের স্ত্রী”পরিচয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আবার “মিলি”কে খুঁজে পেলাম……..!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

About Author

Donation

Support Our Cause

HerWILL is a nonprofit organization. Your support enables us to accomplish our ambitious goals.

Related Posts

Recent Posts