Freedom Comes With Price

স্বর্ণ দিয়ে কেনা স্বনির্ভরতা

বিয়ের আগেই বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার হবু স্বামীর পছন্দ স্বনির্ভর স্ত্রী। তখন অল্পবয়স ছিল, বিয়ে নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ পাবার আগেই পরিবার থেকে একেবারে উঠেপড়ে আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তখন বিয়ে মানেই আমার কাছে শুধু ফুর্তি ফার্তি। যদিও বিয়ে করার সময়ই বুঝে গিয়েছিলাম যে ব্যাপারটা আসলে ফুর্তির কিছু না। তবুও “স্বনির্ভরতার” মতো জটিল বিষয় নিয়ে সেই সময় তেমন কিছু ভেবে উঠতে পারিনি।

বিয়ের পরপরই দেশের জীবনের পাট চুকিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমার স্বামীর সাথে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। প্রবাসে নতুন সংসার শুরু করার পর বুঝতে পারলাম যে একজন পুরুষের স্বনির্ভরতা অর্জন আর একজন নারীর স্বনির্ভরতা অর্জনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। স্বনির্ভরতা বলতে তখন আমার একটা চাকরি বাকরি জোগাড় করে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের কথাই মাথায় এসেছিলো। কিন্তু আমি দেখলাম একজন পুরুষের পক্ষে ব্যাপারটা যতটা সহজ, একজন মহিলার পক্ষে ততটা সহজ না। একজন স্ত্রীর সংসারের দায় দায়িত্ব সমাজের চোখে ভিন্ন। সেই ভিন্নতার যৌক্তিকতা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক থাকতে পারে। তাছাড়া এই বিষয়টা একজন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে মনে হবে একজন মহিলার পক্ষে খুশি মনে সংসার করা যতটা সহজ একজন পুরুষের পক্ষে সেটা সম্ভব না। কেননা একজন পুরুষের দায় দায়িত্ব সমাজের চোখে ভিন্ন। যাহোক, কঠিন আলোচনায় না গিয়ে সহজ কথায় আসি। বিয়ের পর দেখলাম কর্মজীবী হওয়া যতটা সহজ ব্যাপার ভেবেছিলাম ততটা সহজ না। আদতে যে বেকারই না, যার জীবন সংসারের কার্যকলাপে পরিপূর্ণ তার আবার কর্মজীবন কিসের? এর মধ্যে কিছু বুঝে উঠার আগেই ব্যাপারটা আরেকটু জটিল করে দিয়ে আমার কোল জুড়ে আসে ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ে। সংসারের মায়া না হয় কাটানো গেলো, কিন্তু এই ফুটফুটে মেয়েটির মায়া কাটিয়ে উঠা তো দেখলাম রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। আর ধীরে ধীরে আমি আটকে যেতে থাকি আমার সংসার আর সন্তানের মায়াজালে।

তবে ছোটবেলা থেকে আমি বেশ স্বনির্ভর ভাবে বড় হয়েছি। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে অর্থনৈতিকভাবে কারও মুখাপেক্ষী থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। সে যত আপনজনই হোক না কেন। আমার স্বামী যদিও তার স্ত্রীর উপার্জনে সংসার চালানোর জন্য মোটেও উদগ্রীব না, কিন্তু তারও পছন্দ শক্ত সামর্থ্য আত্মনির্ভরশীল স্ত্রী। তবে আমার স্বামীর পছন্দ অপছন্দের জন্য ঠিক না, আমার নিজের জন্যই আমি আদা জল খেয়ে সংসার আর সন্তানের মোহ কাটিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের পিছে ছুটলাম।

আমাদের প্রবাসজীবনে সন্তানের দেখাশুনা করার জন্য যদিও আমাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, কাজের মানুষ নেই কিন্তু অনেক ডেকেয়ার সেন্টার, চাইল্ড মাইন্ডার আর নার্সারি আছে। আমার কাছে এগুলোই উত্তম ব্যবস্থা মনে হয়েছিল। ঐযে বলেছিনা কারও উপর নির্ভরশীল হতে আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু আবারও ব্যাপারগুলো যত সহজ ভেবেছিলাম, আসলে অতটা সহজ না। এদেশের বাচ্চাদের ফুল টাইম রক্ষনাবেক্ষনের ব্যবস্থাগুলো সব খুব বেশি হলে সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চালু থাকে। তাই এমন দূরে কোথাও চাকরি নেওয়া সম্ভব না যেখানে আমার মেয়েটিকে সময়মত উঠা নামা করানো যাবেনা। আমার স্বামী সব বিষয়ে সহায়তা করতে সদা প্রস্তুত এবং করেও থাকে কিন্তু তার চাকুরীর জন্য তাকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয় আর প্রায়ই দেশের বাইরে থাকতে হয়। তাই আমার পক্ষে আমার শহরের বাইরে কোথাও চাকরি নেওয়া সম্ভব না। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে কোনোরকমে বাসার কাছেই একটা দোকানের টিলে সেলস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ জোগাড় করতে সক্ষম হলাম। কিন্তু বেতন খুবই সামান্য। এদেশে বাচ্চাদের চাইল্ডকেয়ার খুবই ব্যয়বহুল। হিসাব করে দেখলাম আমার মাসিক আয়ের সবটুকুই চলে যাবে সেই চাইল্ড কেয়ারের পিছনে। হাতে যা থাকবে তা দিয়ে নিজের যাতায়াতের খরচ বা হাত খরচটাও ঠিক হাতে থাকবে না। কিন্তু কী আর করা? এর চেয়ে ভালো কিছু জোগাড় করতে পারছিনা দেখে সেটাই শুরু করে দিলাম।

ছোটবেলা থেকে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দে বড় হয়েছি। প্রাচুর্য না থাকলেও কখনও অর্থকষ্ট ছিলোনা। কিন্তু নিজে চাকরি শুরু করার পর জীবনে এই প্রথম অর্থকষ্ট উপলব্ধি করলাম। মাস শেষে কিছুতেই চাইল্ডমাইন্ডারের খরচটা তুলতে পারছিলাম না। একেবারে বুকের শিশু সন্তানকে সারাদিনের জন্য ছেড়ে থাকার মানসিক কষ্ট ছিল বর্ণনাতীত, তার উপর সাত সকালে উঠে বাচ্চাকে তৈরি করে বের হওয়া আর দিন শেষে ঘরে ফিরে বাচ্চার আর সংসারের কাজ করার শারীরিক কষ্টতো ছিলই। কিন্তু সব কষ্ট ছাপিয়ে যেই কষ্ট প্রকট রূপ ধারণ করেছিল তা হলো আর্থিক কষ্ট। মাস শেষে চাইল্ড মাইন্ডারের বেতন পরিশোধ করতে পারবো কি পারবোনা সেই চিন্তায়ই আমি অস্থির থাকতাম। ইচ্ছা করলেই আমি আমার স্বামীর কাছে চাইতে পারতাম। কিন্তু সেসময় নতুন প্রবাস জীবনে এমনিতেই আমাদের টানাটানির সংসার, নিজের চাকরির জন্য বাড়তি খরচ সৃষ্টি করার কোনো মানে হয়না। তাই চাইতে পারিনি।

জীবনে সমস্যা যেমন আছে, সমাধানও তেমন আছে। সমাধানগুলো শুধু একটু কষ্ট করে খুঁজে পেতে হয়। বিদেশে চলে যাবো দেখে আমার বিয়ের সময় কাছের সব আত্মীয় স্বজনরা অন্য কোনো উপহার উপযুক্ত না মনে করে সবাই আমাকে সোনার গয়না উপহার দিয়েছিলো। সোনার গয়নার প্রতি আগ্রহ আমার কোনোদিনই ছিলোনা। অনেক গয়নাই আমি বিয়ের পর খুশি মনে অন্যদের উপহার দিয়ে দিয়েছি। তারপরও মা আর শাশুড়ির চাপে অনেককিছুই বিদেশে সাথে করে নিয়ে আসতে হয়। তাদের ভাব দেখে মনে হয়েছিল নতুন বৌ বিদেশে গিয়ে বেনারসি শাড়ি আর গয়না পরে ঘুরে বেড়াবে। বেনারসি শাড়ি আর গয়না পরে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা বা সুযোগ কোনোটাই আমার বিদেশে হয়নি কিন্তু সেই মা আর শাশুড়ির গছিয়ে দেওয়া স্বর্ণালংকারগুলো যেন আমার জীবনের নতুন দ্বার খুলে দেয়। প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও, অনেক চিন্তা ভাবনা করে এক ভারতীয় স্বর্ণের দোকানে আমার এক চাচার দেওয়া উপহারের সেটটা বিক্রির চেষ্টা করি। লুকিয়ে লুকিয়ে এই কাজটা করতে নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়। আরও খারাপ লাগে যখন দোকানদার নিজেই আমাকে বলে যে এতো ভালো স্বর্ণ এদেশে বিক্রি করার মতো লোকসান নাকি আর কিছু নেই। কিন্তু তারপরও আমি সেটটি বিক্রি করে দেই। কয়েক মাসের চাইল্ডমাইন্ডারের বেতনের চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেই। এতে করে কোনো মানসিক চাপ ছাড়া আমি নিজের বেতন থেকে ভবিষ্যতের চাইল্ড মাইন্ডারের বেতনগুলো জমানোর সুযোগ পেয়ে যাই। এরপর থেকে আমার সাহস বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে নিজের যাবতীয় প্রয়োজনে সন্তর্পনে গয়নাগুলোর সঠিক ইস্তেমাল করা শুরু করি।

-এদেশের পড়াশুনা না থাকলে ভালো চাকরি পাবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু পড়াশুনা করা বিশাল খরচের ব্যাপার। কী আছে জীবনে, গাদাখানিক গয়না বিক্রি করে চাকরির পাশাপাশি পার্ট টাইম পড়াশুনা শুরু করে দিলাম।

-ডাইভিং শেখার প্রয়োজন। অনেক খরচের ব্যাপার। দিলাম কিছু গয়না বিক্রি করে।

-আরেকটু ভালো চাকরি পেয়েছি কিন্তু ড্রাইভ করে যাওয়া ছাড়া সম্ভব না? এদেশে সস্তায় সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনা যায়। কিনলাম না হয় গয়না বিক্রি করে একটা গাড়ি।

এভাবে একে একে নিজের প্রয়োজনে আমি আমার বিয়ের উপহারগুলো নিঃশেষ করে ফেলি। মুরুব্বিরা অনেকেই আঁচ করতে পারে যে আমার কাছে গয়নাগুলো আর নেই। তাদের ধারণা আমি বেয়াদব মেয়ে বা বৌ। মুরুব্বিদের দেওয়া আশীর্বাদের কদর করা আমি শিখিনি। কিন্তু আমার তো মনে হয় তাদের আশীর্বাদের যথাযথ মর্যাদা আমি দিতে পেরেছি। গয়নাগুলো থাকলে হয়তোবা সেগুলোর কোনো মূল্যই আমার কাছে থাকতোনা। কিন্তু এখন প্রত্যেকের দেওয়া উপহার আমি আলাদা করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করি। তাদের প্রত্যেকের উপহার আমাকে আমার কাঙ্খিত স্বনির্ভরতা অর্জনে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আজ চলার পথের প্রতিটা মুহূর্তে আমি তাদের অবদানের কথা মনে করে কৃতজ্ঞতা বোধ করি।

এতো গেলো অনেক বছর আগের কথা। আজ আমার সোনার গয়নাও নেই আর সেগুলোর প্রয়োজনও নেই। আজ চাইলে আমি যত গয়না বিক্রি করেছি তার চেয়ে বেশি গয়না গড়িয়ে নিতে পারি। কিন্তু আজ সেই গয়নার থেকেও মূল্যবান জিনিষ আমার আছে, তা হলো স্বনির্ভরতা। যদিও স্বনির্ভরতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে ভিন্ন আর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাই সব না। কিন্তু আমার কাছে এই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছিল অনেক মূল্যবান, এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে দিয়েই আমি আরো অন্যান্য অনেক ব্যাপারে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। তাই আমার মনেহয় গয়নাগুলো হারিয়ে আমার জীবনে যা প্রয়োজন ছিল, যা আমাকে মানসিক প্রশান্তি দান করতে পারে তা আমি অর্জন করেছি। গয়না দিয়ে আমি কী করবো?

আজ আমার একমাত্র মেয়ে নিজে সংসার করছে, মা হয়েছে, নিজের জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের একমাত্র সন্তান হবার কারণে সে সব সময়ই ছিল ভীষণ প্রিভিলিজড। স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য যা যা প্রয়োজন তা তাকে ছোটবেলা থেকে দেবার চেষ্টা করেছি, প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবকিছু হাতের মুঠোয় থাকার পরও সে যেন একেবারে হিমশিম খাচ্ছে। সংসার, সন্তান, স্বামী, নিজের চাহিদা সবকিছুর চাপে পড়ে তার একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। সে আজকাল প্রায়ই আমার কাছ থেকে জানতে চায় যে তার কী করা উচিত। কোনটা বেশি ইম্পরট্যান্ট? নিজের স্বনির্ভরতা, সন্তানের প্রতি মনোযোগ, নিজের চাহিদা, স্বামীর ইচ্ছা? এই যুগ যুগ ধরে চলে আসা মেয়েদের সেই চিরাচরিত সব সমস্যা। বিদেশে বড় হওয়া একজন আধুনিক, শিক্ষিত, আপাতদৃষ্টিতে সফল মেয়েরও এই একই যুদ্ধ দেখে আমি মোটেও অবাক হইনা।

তাকে আমার কী বলা উচিত এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু চিন্তা করে মনে হলো আমার তাকে বলার মতো কিছুই নেই। তার জীবনের যুদ্ধ তাকেই করতে হবে। প্রত্যেকের জীবন আলাদা, প্রত্যেকের জীবনের প্রয়োজনও আলাদা। আমার জীবনে যা ইম্পরট্যান্ট ছিল তার জীবনে তা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তাকেই বের করতে হবে তার কী প্রয়োজন। কী তাকে প্রশান্তি দান করতে পারবে আর সে অনুযায়ী তাকেই যুদ্ধ করতে হবে। আশাকরি সেও যুদ্ধের হাতিয়ার খুঁজে পেয়ে তার যথার্থ ব্যবহার করতে পারবে। যেমন আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার কিছু গয়না আর তা দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম আমার স্বনির্ভরতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

About Author

Donation

Support Our Cause

HerWILL is a nonprofit organization. Your support enables us to accomplish our ambitious goals.

Related Posts

Recent Posts