মনে আছে, ssc পরীক্ষার পর আমার অবস্থা দেখে আমার মামা বলেছিল, “ধর তুই মারা যাওয়ার পর দুনিয়াতে তোর activity analysis করে রিপোর্ট দেওয়া হল যে, অতিরিক্ত গল্পের বই পড়তে যেয়ে, খারাপ কাজ করার একান্ত ইচ্ছা থাকলেও শুধুমাত্র সময়ের অভাবে করতে না পারায় তোর গুনাহ্ কিছু কম হয়েছে বলে শেষ পর্যন্ত তুই বেহেস্ত পাচ্ছিস। সাথে পুরষ্কার হিসাবে বেহেস্তে আরবী ভাষার পাশাপাশি তোর পছন্দ মতো আরেকটা ভাষা এবং সেই ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবি। তুই কোন ভাষা চাইতি?” আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমি যদি বেহেস্তই পাই তাহলে নিশ্চয় একটু চেষ্টা করলেই ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত বহুভাষাবিদ হতে পারবো। কিন্তু যদি একটা ভাষা চাইতে হয় তবে অবশ্যই বাংলা।
আমার যা কিছু আমি ভীষণভাবে ভালবাসি তার মধ্যে আমার ভাষা একটা। আমি সেইসব বাঙ্গালীদের একজন, যাদের প্রিয় স্মৃতির একটা নানীর কাছে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ শোনা…যারা একসময় সব পত্রিকাকেই ‘বিচিত্রা’ বলত…যারা ছোটবেলায় ডিম, চিনি, লবন টাইপ জিনিসগুলো যেসব পুরনো কাগজের ঠোসে করে বিক্রি হতো সেগুলো পড়তে পড়তে রিডিং পড়া শিখেছিল… যাদের গল্পের বই পড়ার শুরু ছুটির দিন দুপুরে বাবার কাছ থেকে বই(আমার ক্ষেত্রে ‘সেরা সন্দেশ’) পড়া শুনতে শুনতে…যারা তাদের আশেপাশের মানুষদের মধ্যে নণ্টে ফণ্টে আর কেল্টুদাকে হামেশাই খুজে পেত…যারা রাতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক থাকলে তাড়াতাড়ি বাড়ীর কাজ করতে বসতো…যারা নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে বন্ধুত্ব এগোবে কিনা বুঝার জন্য ‘ফেলুদাকে তোমার কেমন লাগে?’ বা ‘তুমি কি তিন গোয়েন্দা পড়?’ টাইপ প্রশ্ন করতো…যারা ভাইবোনরা মিলে ঈদ সালামি সহ সব টাকা মাটির ব্যাঙ্কে জমাতো পছন্দমত বই কেনার জন্য…যারা পুজাসংখ্যা পত্রিকাগুলো কবে আসবে বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো… যারা সপ্তাহে একদিন বইয়ের দোকানে (আমার ক্ষেত্রে জ্ঞানকোষে) যেতে না পারলে অস্থিরতা বা বিষণ্ণতায় ভুগত…যারা বঙ্কিম বা শরৎচন্দ্রের লেখার কোন অর্থ বুঝতে না পারলে; বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মামী, চাচী বা খালার পিছে ঘুরতো…যারা বছরের পর বছর ডায়েরী লিখত আর সেগুলোর কোন একটা হাতে পেলে নিজের সাহিত্য কর্মে এখনও মুগ্ধ হয়….যারা মায়ের বকুনির ভয়ে বাথরুমে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাত জেগে গল্পের বই পড়তো…যারা বন্ধুদের আড্ডায় বাস্তবের থেকে কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে আলোচনা আর সমালোচনা করেই বেশী সময় কাটাতো…যারা দেশ ছাড়ার সময় অনেক প্রিয় জিনিস রেখে আসতে বাধ্য হলেও সিদ্দিকা কবিরের ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ সাথে নেয়…যারা দূর থেকে জাতীয় সঙ্গীতের সুর শুনলেও মনের অজান্তেই দাঁড়িয়ে যায়…..যাদের কলকাতার ময়দান,কলেজ স্ট্রিট,গঙ্গার ধার বা মানিক তলা দিয়ে যাওয়ার সময় খুব পরিচিত লাগে কারন তাদের প্রিয় লেখকদের বইয়ে এসব জায়গার অনেক বর্ণনা পড়েছে…যাদের জঙ্গলের ভেতরে কোন রাস্তা দিয়ে যেতে গেলেই বুদ্ধদেবকে মনে পড়ে… যাদের প্রিয় গানের তালিকায় হিন্দি, উর্দু, ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ অনেক ভাষার গান থাকলেও মন খারাপ লাগলেই রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে বসে…যাদের কাছে বাংলাদেশের সব আঞ্চলিক ভাষাই খুব শ্রুতিমধুর লাগে,একই মনের ভাবকে কত ভিন্ন শব্দ আর উচ্চারণে প্রকাশ করা যায় তার তুলনা করেতে যারা মজা পায়… যারা ট্রেড ফেয়ারের থেকে বই মেলায় যেতে বেশি ভালবাসে…………………………………………………………….……………আর যারা বাংলা ভাষা ছাড়া নিজের অস্তিত্ব কেমন হতো কল্পনাও করতে পারে না। সবাইকে মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা।