যখন আমার বয়স তের কি চৌদ্দ তখন থেকে আমি লেখালেখি করতে ভালোবাসি । তখন এত কিছু বুঝতে পারতাম না হয়তো ,তবুও এটা বুঝতে পারতাম যে কষ্ট পেলে অথবা ভীষণ দুঃখ না পেলে ভাল কিছুই সৃষ্টি হয়না। আমি তখনই লিখতে পারতাম যখন আমার ভিতরে কোন দুঃখবোধ কাজ করতো। তাই আমি ভাবতাম আমার জীবনে দুঃখ থাকাটা জরুরি । না হলে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তারপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হলাম তখন সবাই বলতো , “প্রেম করেছো? প্রেমে ব্যর্থ না হলে ভাল ছবি আঁকা যায় না।” ওই একই কথা দুঃখ না পেলে ভাল ছবি আঁকা যায় না ।
এখন এই বয়সে এসে দেখি যে মানুষ জীবনে যত বেশী কষ্ট করেছেন ,দুঃখ পেয়েছেন সেই তত সফল হয়েছেন, নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুঁজে পেয়েছেন তখন ভাবি আমার ছোটবেলার ভাবনাটাই ঠিক।আমি বলছি জীবনে দুঃখ অথবা কষ্ট আসলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই । দুঃখের পরেই সুখ আছে , যেমন রাতের পর আসে দিন আর অন্ধকারের পর আসে আলো।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “যার জীবনে যত পরিবর্তন যত সমস্যা আসবে, সে ততই সফল হবে। কারন প্রতিটি সমস্যাই একটি করে নতুন সুযোগ নিয়ে আসে।”
আপনারা সবাই হয়তো পাকিস্তানের লৌহমানবী মুনিবা মাজারীর কথা শুনেছেন। যিনি মারাত্মক কার এক্সিডেন্টে মেরুদন্ডসহ সমস্ত শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে পরবর্তীতে প্যারালিসিস হয়ে যায়। সেখান থেকে কিভাবে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন । হয়েছেন ফোবসের বিশ্ব সেরা তিরিশ জন নারীর একজন । এই মারাত্মক এক্সিডেন্ট তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন । তার প্রচন্ড কষ্ট আর বেদনাকে তিনি জয় করেছেন ছবি এঁকে, মানবাধিকার কর্মী হিসেবে হয়ে উঠেছেন অসামান্য একজন । হুইলচেয়ারে বসে জয় করেছেন বিশ্ব , শোনাচ্ছেন অনুপ্রেরণার বাণী।
আমার একজন প্রিয় শিল্পী যার নাম ফ্রিদা কাহলো ।তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন ডাক্তার । সবাই হয়তো জানেন গুরুতর এক্সিডেন্টে যখন সারা শরীর অসার হয়ে যায় হসপিটালে বসে বসে ছবি আঁকা শুরু করেন। সেই ছবি আঁকাআকি তাকে মেক্সিকোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত এনে দেন। শুধু মেক্সিকান নন আমার মতে তিনি বিশ্বের একজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্টিস্ট ।আমার সবচেয়ে ভালোলাগার শিল্পী ফ্রিদা ।
জনপ্রিয় হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা যে কে রাউলিং, সবাই তাকে চিনেন তার লেখার জন্য । কিন্তু তার সফলতা পিছনের কষ্টটা জানে কতজন। যিনি বিবাহিত জীবনে সুখী ছিলেন না ফলে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তারপর তার একটি কন্যা সন্তান নিয়ে তিনি অনেক কষ্টে দিন যাপন করছিলেন। বিষন্নতা আর হতাশা এত চরম ছিল যে এক পর্যায়ে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু হার মানেননি কষ্টের কাছে। দিনের পর দিন লেখালেখি চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে লিখে ফেলেন হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম উপন্যাসটি। বই প্রকাশের জন্য বিভিন্ন স্থানে পান্ডুলিপি পাঠিয়ে সারা পাননি। ১২ বার বিভিন্ন প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তারপর প্রকাশের পাঁচ মাসের মাথায় জিতে নেন সেরা শিশু সাহিত্যর পুরস্কার । তারপর সব ইতিহাস সবাই জানে।
ব্রিটিশ গায়িকা অ্যাডেলের বয়স যখন মাত্র চার বছর তার বাবা তাদের ছেলে চলে যান। আঠারো বছর বয়সী তার মা তাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের অড জব করে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করেন । কিন্তু মেয়েকে মিউজিকের জন্য যা কিছু দরকার সব কিছু কিনে দিতেন।দশ বছর বয়সে তার নানা মারা যাওয়ার পর থেকে অ্যাডেলে খুব ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন। কারন নানাকে অ্যাডেলে খুব ভালবাসতেন। তারপর সে ভাবেন হার্ট সার্জন হবে কিন্তু পরবর্তীতে মিউজিক স্কুলে ভর্তি হন। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে তার প্রথম এলবাম ১৯ বের হয় আর বিক্রি হয়ে যায় দশ লক্ষেরও বেশি কপি। তখন তিনি তার চেয়ে দশ বছরের বেশি বয়সী এক ফটোগ্রাফার এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। মাত্র আঠারো মাস পরে ওই ফটোগ্রাফার তাকে ছেড়ে অন্য আরেকজনকে ভালোবাসেন । এতে অ্যাডেলে খুব মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর লিখেন someone like you আর এটি স্মরণকালের সবচেয়ে হিট গান এটি।
দুর্ভাগ্য অ্যাডেলের পিছু ছাড়েনি কোনদিন কিন্তু তিনি হার মানেননি কখনো । ২০১১ সালে তার গলায় অপারেশন হয় তাকে গান গাওয়া ছেড়ে দিতে হয় । কিন্তু তিনি ২০১২ সালে আবার ফিরে আসেন গানের জগতে । আর জিতে নেন ছয় ছয়টি গ্র্যামি পুরস্কার। এখন তার বয়স ২৯ এর মধ্যে জিতে নিয়েছেন বারোটি গ্র্যামি পুরস্কার আর১০০ মিলিয়ন রেকর্ড বিক্রি করেছেন। আর টাইম ম্যাগাজিন অনুসারে দুই দুইবার জিতেছেন পৃথিবীর অন্যতম প্রেরণাদায়ক নারীর পুরস্কার ।
আমরা যে ধরনের বিপদ বা খারাপ পরিস্থিতিতেই পড়ি না কেন, এইসব সফল মানুষদের ব্যর্থতার গল্প এবং ব্যর্থতাকে জয় করার গল্প যদি আমরা মাথায় রাখি তবে পথ চলতে সাহস যোগাবে। যে কোনও ব্যর্থতা থেকেই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পাবো আমরা। আমার তাই ভালো লাগে এদের গল্প পড়তে। আর আমি চাই জগতের সকল নারী জিতে যাক জীবনের যুদ্ধে তাই এই নারীদের সফলতার গল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
আমার ছবি আঁকার প্রিয় বিষয় বন্ধ দরজা, এগুলো আমার পছন্দের ছবি।