Rakhi Nahid | IWD 2021

আমার এক সহকর্মী আছেন যিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন মায়াবতী। যার স্বভাবই অন্যকে যত্ন করা।যেন আশেপাশের সবার ভালোমন্দ দেখার অলিখিত কোন দায়িত্ব উনাকে দেয়া হয়েছে।

কি ঝকঝকে একজন মানুষ, সারাদিন হাসেন, সুন্দর করে কথা বলেন। উনি আশেপাশে থাকলেও একটা ফিল গুড ব্যাপার হয়।

আমি উনাকে দেখি আর ভাবি, অতি সুন্দরীরা সাধারণত মায়াবতী হয় না। এই মহিলা দুই ক্যাটাগরিতেই পড়েন। ইনি যার স্ত্রী, কত ভাগ্যবান সেই লোক !

কাজের যায়গায় আমরা কারো পার্সোনাল লাইফ ডিসকাস করিনা।বরং ভীষন সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাই এই ধরণের কৌতূহল।

তবে একদিন কথা প্রসঙ্গে এই মায়াবতী নিজের কিছু ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করলেন আমার কাছে। উনার কথা শুনে ঘোরের মত লাগলো আমার।

এই আপা তার ২৭ বছরের দাম্পত্যের ইতি টেনেছেন কিছুদিন আগে।

অল্প বয়সে বিয়ে।পড়ালেখা শেষ হবার পর তার স্বামী তাকে কাজ করতে দেননি।থিয়েটারের শখ ছিল। স্বামীকে সে কথা জানাতেই বলেছিলেন

– থিয়েটার করা চরিত্রহীন মেয়েদের কাজ।

নিজের সব ইচ্ছা, মেধা, শখকে মাটিচাপা দিয়েছিলেন দাম্পত্যের শুরুতেই। তারপর হলেন দুই কন্যার মা।কন্যাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার নামক হাজতবাস করে গেছেন বছরের পর বছর।

যে হাজতে কয়েদীরা জানেই না তারা সাজা কোন অপরাধের ভোগ করছেন।

সুন্দরী শিক্ষিতা গুণবতী হবার অপরাধে শাস্তি ? নাকি শুধুমাত্র নারী হয়ে জন্ম নেবার শাস্তি ?

প্রায় ২০ বছর হাজত বাসের পর রিয়েলাইজশন হয়

– একটা জীবন শুধু বঞ্চিত হয়েই কাটিয়ে দিব? একবার টেস্ট করে দেখব না মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে কেমন লাগে।

সেই রিয়েলাইজেশন থেকে দাম্পত্য সম্পর্কের চরম অবনতি, সেপারেশন এবং ডিভোর্স।

কন্যাদেরকে তাদের পিতা দেননি মায়ের কাছে আসতে। গত পাচ বছর ধরে উনি একা। সাবলেট থাকেন একজন বয়স্কা বিধবা মহিলার সাথে।

এখন শখ মিটিয়ে কাজ করেন, ইনকাম করেন, মেয়েদের নিয়ে শপিং এ যান , মাঝে মাঝে ওদের নিয়ে ঘুরতে চলে যান বিভিন্ন যায়গায়, তাদের পছন্দের খাবার রান্না করে পাঠান।

কন্যাদেরও পূর্ণ সমর্থন আছে মায়ের সিদ্ধান্তে।

জিজ্ঞেস করলাম

– প্রথম প্রথম ভয় লাগেনি আপা? বিশ বছর কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার পর, ঘরভরা মানুষের সাথে বসবাসের অভ্যাসের পর, হঠাত পুরো একা?

বললেন

– লেগেছে প্রথমে একটু। কারন বন্দীদশায় থাকতে থাকতে আমারো বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে আমি একা সারভাইভ করতে পারবো।

কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে একবার ঢুকে পড়ার পর রণকৌশল বুঝে ফেলেছি। বুঝে ফেলেছি, কিভাবে জয়ী হতে হয়।এখন মনে হয় চল্লিশ বছর বয়সে এসে হলেও কি ভালো সিদ্ধান্তটাই না নিয়েছিলাম।

নইলে জানতামই না যে আমি এত আত্মনির্ভরশীল । আমার বেঁচে থাকার জন্য কোন পুরুষের সাহায্যের দরকার নেই।

উনার কথা শুনে মনে হল,

সত্যি কি আজব এক নিয়ম,

প্রথমে কারো হাত পা বেঁধে তাকে পঙ্গু করে রাখা হবে তারপর প্রতিনিয়ত বোঝাতে হবে তুমি আমার উপর নির্ভরশীল অতএব আমার আজ্ঞা পালন করো। কি অদ্ভুত।

গল্প শেষে ওই আপার দিকে তাকিয়ে আমার একটা শের মনে পড়ে গেলো

“মাঞ্জিল উসি কো মিলতি হ্যায়

জিনকে সাপ্নো মে জান হোতি হ্যায়

পাঙ্খ সে কুচ নেহি হোতা

হসলো সে উড়ান হোতি হ্যায়”

অর্থাৎ

গন্তব্যে সেই পৌঁছায়,

যে স্বপ্ন দেখতে পারে।

পাখা দিয়ে কিচ্ছু হয়না,

মানুষ তার ইচ্ছা দিয়ে উড়ে।

হয়ত এমন কিছুই এচিভমেন্ট হয়নাই উনার।

উনি কল্পনা চাউলার মত মহাকাশে যান নাই, ম্যারি ক্যুরির মত বৈজ্ঞানিক আবিস্কার করে নোবেল পান নাই, ফুলন দেবী হন নাই,মালালা ইউসুফজাই, ফ্রিদা কাহ্লো, কমলা দেবী হন নাই।

কিন্তু দিন শেষে উনার সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট উনি মানুষ হয়েছেন……..

সকল নারী দি বস যারা নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে খুঁজে পেয়েছেন তাদেরকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

About Author

Donation

Support Our Cause

HerWILL is a nonprofit organization. Your support enables us to accomplish our ambitious goals.

Related Posts

Recent Posts